দেশ ব্যাপি আলো ছড়ানো পাঠাগার আন্দোলন সৃষ্টির গোঁড়ার কথা

কুমিল্লা এসডি নিউজ ডেস্ক :

রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু এক খানা বই অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয় (পারস্যের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম এই অসাধারণ উক্তিটি করেছিলেন)। বই নিয়ে করা বহু উক্তি হতে এই উক্তিটি টেনে আনলাম- কারণ জীবনের নিত্যসঙ্গী রুটি ও প্রিয়া একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে কিন্তু একটি বই মহাকালে স্মৃতিকে জীবিত করে রাখবে এই উপলব্ধি থেকে। বইয়ের আবদার কে আন্তরিকতার সহিত সশ্রদ্ধ স্বাগত জানিয়েছেন কালক্রমে এই ধরালয়ে এসেছেন বহু বই দরদীরা। তাদের সমগ্র দেমাগ জুড়ে বইয়ের কদর ছিল দৃষ্টিনন্দিত। আসলে বইয়ের ব্যাপারে যে বিখ্যাত মানুষেরও দৃষ্টি কটু কাজ দেখা যায় – সেকথা হয়তো আমরা ইংল্যান্ড এর নামকরা বই প্রেমী মার্ক টোয়েনের থলিতে পাব। যার সংগ্রহিত বইয়ের স্তর ছিল ঘরের মেঝ হতে ছাঁদ পর্যন্ত। যিনি তার সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন বইয়ের পেছনে দৌড়ে। অবশেষে এই বই সন্ন্যাসী মার্ক টোয়েন বিশ্ব স্মৃতির পটে স্বর্ণাক্ষরে নাম লিখিয়ে তার শত শত ভক্তদের চোখের জলকে উপেক্ষা করে পাড়ি যমান না ফেরার দেশে।

আর এই মার্ক টোয়েনর একজন নগন্য ভক্ত হিসেবে নান্দনিতায় নন্দিত অনিন্দ্য সুন্দর সবুজ শ্যামল তরু-তণ্যের থোকায় থোকায় লাল সবুজের আঁল্পনা আঁকা গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল কুমিল্লা শহরের উপকন্ঠে এক অজঁপাড়া গাঁয়ের নিম্নবিত্ত গৃহনে নিজেকে আবিষ্কার করি ২০ অক্টোবর ১৯৮৯ সালের দিবসটি ছিল শুক্রবার ।
জনক-জননীর অষ্ট অবলম্বনের মধ্যে সর্বকনিষ্ট হয়ে জন্মাবার সুযোগ হয়েছিল আমার, যার জন্যে পরিবারের দায়ভার বা তদারকির বিষয়টা এখনো হাতের নাগালের বাইরে হওয়ায় হয়তো এই দিকে জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করার সুযোগ হচ্ছে ।
যে সমাজে জীবনের নয়া শাখা-প্রশাখা গজিয়েছিল সে সমাজ টা ছিল মূলত পুঁজিবাদী, পরিবেশটা ছিল বেশ বৈরী আর বেগটা ছিল শত প্রতিবন্ধকতায় ভরপুর। বইয়ের প্রতি অপরসীম দরদ ও ভালবাসা জন্মে কৈশোরের সূচনালগ্নে। তখন পড়ি সপ্তম শ্রেনীতে। তখন থেকেই গলাদকরণ করতে থাকি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, মনীষী, সাহিত্যিক ও সমাজসেবীদের জীবনী ও তাদের শ্রেষ্ঠ কর্ম। বিশেষ করে- বিদ্রোহী কবি নজরুল, কবিগুরু রবি ঠাকুর, জর্জ বার্নাড’শ, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, টমাস আলভা এডিসন, পল পি হ্যারিস, শেখ সাদী, নওয়াব আব্দুল লতিফ, বিদ্যাসাগর ও হাজী মহসীন সহ আরো অনেকের।
তখন থেকেই মনে-প্রানে অভিপ্রায় জাগে আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ যদি তাদের মতো হতো । তারপর আত্মোপলব্ধি করি যে শিক্ষার বিকল্প কিছু নেই। ঠিক তখন প্রত্যাশা ও দৃঢ় প্রত্যয় করি এই বাংলার প্রতিটি মানুষের কাছে যাব বইয়ের আকুতি নিয়ে যা কালক্রমে ছড়িয়ে পরবে পৃথিবীর পথে পথে। আর বলবো “ আসুন, শিক্ষা-সাম্য-শান্তি-একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দেশটা গড়ে তুলি এবং একটি শিক্ষিত জাতি বিনির্মাণ করি।
সে থেকে হাটি হাটি পা পা করে বন্ধুর পথ চলা। বুকভরা আশা,সাহস,ত্যাগ,ধৈর্য্য ও আত্মোবিশ্বাস ঢেলে গড়ে তুলি বইয়ের জনপদ। বর্তমান প্রায় ২০-২১ সহা¯্রাধিক বই নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসা জন্মে বইয়ের প্রতি। চায়ের দোকানের কাজ থেকে শুরু করে দিনমজুরির কাজ, মাটিকাটা, ম্যানহুলের কাজ, দারোয়ানী, বাসার কাজ, রাজজোগালী, কাঠমিস্ত্রী ও সয়েল টেস্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সহ প্রায় সব রকমের পেশায় সময় দিয়েছি। কারণ আমাকে অনেক অনেক বই কিনতে হবে এবং এদেশে প্রতিটি মানুষের কাছে বইয়ের কদর পৌছাতে হবে। আর কাজের তাগিতে যেতে হয়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর,শহর থেকে শহরান্তর। কুমিল্লার অলি-গলি হতে শুরু করে চাঁদপুর, বি-বাড়িয়া, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী সহ চট্টগ্রামের বহু স্থানে – নিউমার্কেট, কদমতলী, বদ্দারহাট, দুই নাম্বার,ষোলশহর,অলংকার,অক্সিজেন,রূপনগর,পাঁচলাইশ,টার্মিনাল ও জি ই সি মোড় সহ আরো অনেক স্থানে ।
প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি “ষোলশহর রেল জংশন এর পশ্চিম পাশের একটি বস্তিতে ৬০০ টাকা ভাড়ায় একটি রুমে থাকতাম আমরা চার বন্ধু আমি,মোরশেদ, হাবিব ও বিল্লাল। ২০দিন পর বিল্লাল ও মোরশেদ বাড়িতে চলে এল। পর্যায়ক্রমে হাবিব ও আমাকে ছেড়ে চলে এল বাড়িতে। তখন আমরা ১২০ টাকা বেতনে শ্রম দিতাম ২০০৬ সালের প্রথম দিকে। আমি বাড়িতে আসলাম না,কারণ আমাকে অনেক বই কিনতে হবে -এই ভেবে রুম ছেড়ে চলে এলাম ষোলশহর জংশনের যাত্রী চাউনিতে । রাতে জংশনের ট্রেনের একটি বগিতে ঘুমাবার জন্য বগিটি খুলতে গেলে ডাকাত ভেবে পুলিশ এসে হাত কড়া লাগিয়ে জংশনের একটি রুমে আটকিয়ে রাখে। পরে স্থানীয়দের সহায়তা ১৫০ টাকা জরিমানায় ছাড়া পেলে মাসে ১৫০০ টাকা বেতনে নিকস্থ একটি শপিং মলের দারোয়ানী চাকরি নেই। এক সময় হাজার দু’য়েক টাকা হাতে জমা হলে তা দিয়ে বেশ কিছু বই কিনে পাড়ি যমালাম নাড়ির টানে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

আমার এই সকল কর্মের পেছনে উৎসাহের আঞ্জাম দিত আমার প্রিয় মা, বন্ধুমহল ও প্রিয় জহির স্যার, মিজান স্যার, আমির স্যার, জাকারিয়া স্যার সহ আরো অনেকেই। বই সংগ্রহের ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন আমার মাধ্যমিক পর্যায়ের ইংরেজী শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মো: সিরাজুল ইসলাম স্যার ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ধামতীর শ্রদ্ধেয় মো: মাহবুবুর রহমান চৌধুরী স্যার। তাঁরা প্রচন্ড বই প্রেমে মগ্ন একজন মানুষ। যারা সবসময় আমাদের কে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়তে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
আমার এখনো মনে পরে জীবনের প্রথম এবং পাঠাগারের প্রথম বই টা কিনেছিলাম ডা: লুৎফুর রহমান এর লেখা “মানব জীবন” বইটা। বইটার দাম ২০ টাকা দিনটি ছিল পহেলা জানুয়ারি ২০০৫ সালের রোজ শনিবার বিকাল ৫ টা,তাজ লাইব্রেরী,সুয়াগাজী,সদর দক্ষিণ,কুমিল্লা।
শুরু হলো বই কেনার/সংগ্রহের এভারেস্টের ন্যায় স্বপ্ন আর বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় বেগ। যা উল্লেখ না করলেই নয়, যে প্রবন্ধ গুলো বইয়ের প্রতি আমার ভালবাসার মাত্রা বাড়িয়ে ছিল তাহলো রবি ঠাকুর এর “লাইব্রেরী” ও “বই পড়া” প্রবন্ধ এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর “বই কেনা” প্রবন্ধ সমূহ ।
একদিন হয়তো আমি থাকবো না কিন্তু এই পাঠাগার আন্দোলন ছড়িয়ে যাবে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে আর বইয়ের আলোয় আলোকিত করবে প্রতিটি মানুষের অন্তরাত্মাকে আর তখনই মানুষ, মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করবে আর ¯্রষ্টা খুঁজে পাবে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য।

     আরো পড়ুন....

পুরাতন খবরঃ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
error: ধন্যবাদ!